পীর হযরত হায়াত উদ্দীন নিমাই শাহ (রাহ: ) এর দরগাহ আরবপুর ইউনিয়নের ভেকুটিয়া শেখ পাড়ায় অবস্থিত। প্রতি বছর ২২ শে চৈত্র দরগাহ শরীফে ঔরশ অনুষ্ঠিত হয়। এ পীর সাহেব কে নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক মিথ। সে অনেক দিন আগেকার কথা। সম্ভবত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে হবে হয়তবা। শতবর্ষী সোনাই বিবি শুনেছিলেন তার পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে।
ভেকুটিয়া বকুলতলা বাজারে ছিল বয়োবৃদ্ধ নরসুন্দর নিমাইয়ের সেলুনের দোকান। বর্তমানের মত এত জৌলুসময় সেলুন সে সময় ছিল না। পিড়ি বা জলচৌকিতে বসিয়ে শান দেয়া ক্ষুর দিয়ে কাজ চালাতেন নরসুন্দরা। এক সকালে নিমাই তার দোকানে বাক্স পেটরা খুলে কেবল ঝাড়া মোছা শুরু করেছেন তখনি আর্বিভূত হলেন সৌম্য শশ্রুমন্ডিত এক পুরুষ। লেবাস আর চেহারা দেখে আপনা থেকেই শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয়। জানতে চাইলেন চুল দাড়ি একটু সাইজ করে দেয়া যাবে কিনা। নিমাই বললেন বসতে হবে। আগন্তক বললেন তার হাতে সময় কম। করলে এখনি করতে হবে। রাশভারী গুরু গম্ভীর বাচনের ব্যক্তিকেআর ঘাটতে সাহস হলো না নিমাইয়ের। কাজ শুরু করলেন।
আনমনে কাজ করছেন আর অবাক চোখে নিরীক্ষণ করছেন নিমাই। হঠাত অনুভব করলেন আগন্তকের ডান পাশটা প্রচন্ড গরম আবার বাম পাশটা প্রচন্ড ঠাণ্ডা। একই মানুষের দুইপাশতো কখনো দু রকম হয় না! তাহলে এনার এ রকম কেন? নিশ্চয় এর মাঝে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। প্রথম থেকেই আগন্তককে তার রহস্যময় মনে হয়েছিল। জিজ্ঞাসা করলে নিশ্চুপ রইলেন। অনেক পীড়াপিড়িতে নিমাই যা শুনলেন নিজের কানকেও তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। দক্ষিণে প্রচন্ড তাপদাহ চলছে আবার উত্তরে প্রচন্ড হিমবাহ চলছে যা তিনি এখানে বসে নিয়ন্ত্রণ করছেন। যে কারনে তার ডানপাশ প্রচন্ড গরম আর বাম পাশ প্রচন্ড ঠান্ডা। সাথে সাথে ভূমিতে পতিত হয়ে নিমাই পা জড়িয়ে ধরলেন,বললেন বাবা আমাকে দীক্ষা দেন। আমি আপনার শিষ্য হতে চায়। মুচকি হাসলেন আগন্তক, শিষ্য হওয়া এত সহজ কাজরে নিমাই। অবাক হলেন নিমাই। তিনি কিভাবে আমার নাম জানলেন। বিস্ময়ের ঘোর আরো ঘণীভূত হয়। যদি আমাকে শিষ্য না করেন তবে আপনার পা ছাড়বো না বাবা। আরো জোরে পা জড়িয়ে ধরেন নিমাই। বয়োবৃদ্ধ নাপিতের কান্ড দেখে রহস্যময় হাসি আকর্ণ বিস্মৃত হয় আগন্তকের। বলেন পারবিতো যা যা তোকে বলবো তা করতে। নিমাই দৃঢ়চিত্তে বলেন অবশ্যই পারবো। প্রচন্ড আগ্রহ দেখে তিনি নিমাইকে শিষ্য হিসাবে বরণ করে নিলেন। শিষ্যত্ব পেয়েই নিমাইয়ের সোজা সাপ্টা প্রশ্ন বাবা আপনি কে ? আগন্তুক বললেন নাম জানা কি এতই জরুরী। নিমাই নাছোড় বান্দা। অগ্যতাশিষ্যের আবদারে জানালেন তার নাম গাজী । গাজী কালু চম্পাবতীর গাজী বাবা! আবারো চরণধূলি কপালে ঠেকান নিমাই। আগন্তক বলেন হ্যা, আমি গাজী বাবা। এ পথে কোথায় যাচ্ছেন বাবা ? নিমাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে জানান মুক্তেশ্বরী নদী পার হয়ে ওপারে আমার আস্তানা আছে,সেখানে যাচ্ছি। নিমাই আবারো পা জড়িয়ে ধরে জানায় বাবা শিষ্য যখন করেছেন আমাকে একটি বর দিতে হবে। গাজী বাবা বললেন বল কি তোর ইচ্ছা। নিমাই জানালেন তাকে আবারো ষোল বছরের যুবকে পরিণত করে দিতে হবে। আশি বছরের বৃদ্ধ, তুই হবি ষোল বছরের যুবক অসম্ভব। আপনি যদি তাপ আর হিমবাহকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তবে বয়স নিয়ন্ত্রণ করা আপনার পক্ষে কিছুই না। আমাকে বর দিন, খালি হাতে আমাকে ফেরাবেন না।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে নাছোড় নিমাইয়েরদিকে চোখ মেলে বললেন সহ্য করতে পারবিতো যুবক হবার যাতনা ? নিমাই এক বাক্যে বললেন পারবো। দোয়া পড়ে মাথায় হাত দিলেন নিমাইয়ের। ভোজবাজীর মত পাল্টে গেল দৃশ্যপট। আশি বছরের নিমাই মুহূর্তেই ষোল বছরের যুবক। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই দেখেন সেখানে কেউ নেই। কোথাই যেন গাজী বাবা উধাও হয়ে গেছেন। মনের খুশীতে বাড়ী গিয়ে বউকে নাম ধরে ডাকলেন। বউতো রেগে আগুন কি বদমাস ছেলে একটা বুড়ীকে বউ বলে ডাকছে। ঝাটা হাতে তেড়ে আসে মারতে। যতই বোঝান তিনি নিমাই কেউ তা বুঝতে চায়না। নিজভূমে পরবাসী হলেন নিমাই। জগত সংসারের প্রতি আসক্তি আর থাকেনা। মুক্তেশ্বরী নদী পেরিয়ে খুজতে খুজতে অবশেষে হাজির হলেন বর্তমানের যশোর বেনাপোল মহাসড়কে নতুনহাট পেরুলেই গাজীর দরগাতে। গাজী বাবা বললেন তোকে আগেই নিষেধ করেছিলাম তুই শুনলি না। এখন কি চাস বল ? নিমাই জানালেন সংসারে আর ফিরবো না। আপনার চরণতলে ঠাই দিন। বাকী জীবন এ ভাবে এখানে কাটাতে চায়। গাজী বাবা বললেন সে হবার নয় তুই গাজীর দরগাতে থাকবি কেন।তুই তোর দরগাতে থাকবি। যা তোর এলাকায় ফিরে। অশ্বত্থ তলে বসে সাধনা শুরু কর। তথাস্ত বাবা। তবে এলাকায় কেউতো আমাকে নিমাই নামে মেনে নেয় নি তবে আমার নাম কি হবে ? মুচকি হাসলেন গুরুজী গাজী বাবা। নতুন হায়াত পেয়েছিস, যা আজ থেকে তোর নাম হায়াত উদ্দীন। সেই থেকে তিনি পরিচিত হযরত হায়াত উদ্দীন নিমাই শাহ (রাহ:)নামে। ভেকুটিয়া শেখ পাড়ায় আস্তানা গাড়লেন অশ্বত্থ তলায়। জীবনের শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন এখানেই। অশ্বত্থ তলেই তার মাজার অবস্থিত। মাজারের পাশেই পীর পুকুর। একটুসামনে এগুলেই মুক্তেশ্বরী নদীর দোহার ঘাট। কথিত আছে দোহার ঘাটে হযরত হায়াত উদ্দীন নিমাই শাহ (রাহ:) গোসল করতেন এবং পুকুরের পানিতে প্রয়োজনীয় কাজ মেটাতেন। দোহার ঘাট এবং পীর পুকুর থেকে নাকি থালা বাসন উঠতো। কারো বিয়ে শাদী কিম্বা যে কোন আয়োজনে থালা বাসন দরকার হলে আগে থেকে বলে আসলে সকালে পাড়ে থালা বাসন উঠে থাকতো। শর্ত ছিল যা যা পানি থেকে উঠবে কাজ শেষে তা আবার পানি ডুবিয়ে দিতে হবে। কে বা কারা একবার নাকি একটি চামচ চুরি করে রেখে দিয়েছিল সেই থেকে এ সব উঠা বন্ধ হয়ে গেছে।দোহার ঘাট নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক গল্প। দোহার ঘাটের তলদেশে মানুষের কোন ঠাই মেলেনা। এত গভীর সেখানে। মানুষের ধারনা দোহার ঘাটের নিচে দেও দৈত্যদের বসবাস। আজো সাধারণ মানুষ মেনে চলেন এ সব। প্রায় দ্বিশত বছর পেরিয়ে গেলেও আজো এ সব কথা প্রচলিত আছে বংশ পরম্পরায়।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS