Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

শিরোনাম
প্রযুক্তিতে মাতৃভাষার ব্যবহার
বিস্তারিত

অজিত কুমার সরকার : কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দেশ’ পত্রিকার একটি কাহিনী মনে পড়ছে। কয়েক বছর আগে পড়া কাহিনীটার একটা অংশ মোটামুটি এরুপ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার লন্ডন থেকে জাহাজযোগে কোলকাতা ফিরছিলেন। একই জাহাজে লন্ডনের কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষারত কোলকাতার বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের এক তরুণও ফিরছিলেন। সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছাকাছি এসে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু সাহসে কুলায়নি। এক পর্যায়ে সাহস করে নিজের পরিচয় দিয়ে সে ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করে। মাঝে মাঝে বাংলায়। তরুণটির গ্রামারহীন ভুল ইংরেজি এবং অশুদ্ধ বাংলা বাক্য ও শব্দের উচ্চারণ শুণে রবীন্দ্রনাথ খুব বিরক্ত হন। তিনি তাকে বলেন, বিলেতে পড়াশুনা করতে গিয়ে ইংরেজিতো কিছু শেখোনি, বাংলাওতো দেখছি ভুলতে বসেছো। তরুণ ছেলেটি বিব্রতবোধ করেন এবং লজ্জায় আর কথা বাড়াননি। রবীন্দ্রনাথ তার গান, কবিতা ও সাহিত্য কর্মের দ্বারা বাংলা ভাষা যে কতোটা সমৃদ্ধ তা প্রমাণ করেছেন। তিনি বাংলাকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন। বাংলা ভাষা ভুলে যাওয়া বা অশুদ্ধ উচ্চারণে তিনি যে আহত হবেন সেটাই স্বভাবিক। ইংরেজি ভাষা শিখতে গিয়ে কেউ বাংলা ভুলে যাবে এটা তিনি মেনে নিতে পারেননি।  

কিন্তু আজকের বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বেও অনেক দেশেই মাতৃভাষা ভুলে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ইংরেজি ভাষার আগ্রাসনের কারনে ভাষা-ই এখন অস্তিত্ব সঙ্কটে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ্যানথোলগ এর গবেষণা অনুসারে, বর্তমানে পৃথিবীতে মানুষ কথা বলে এরুপ ভাষার সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। আগামী শতকে এসব ভাষার অর্ধেকের মৃত্যু ঘটবে। গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের ৪৭৩টি ভাষা এ মূহুর্তে হারিয়ে যাওয়ার ঝুকিতে রয়েছে। ফরাসি ভাষাবিদ ক্লাউড হেজেজ বলেছেন,“ইংরেজি ভাষা যেভাবে প্রভাব বিস্তার করছে তাতে আমরা যদি সতর্ক না হই এক সময় তা অধিকাংশ ভাষার মৃত্যু ঘটাবে।”

ইংরেজি ভাষার প্রভাবে যখন অনেক দেশের মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার ঝুকিতে রয়েছে তখন যে জাতি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে তারা ভবিষ্যতে মাতৃভাষার বিলুপ্তি ঠেকাতে কতোটা সতর্ক সে দিকে চোখ ফেরানো যাক। বাঙালির প্রাণের ভাষা বাংলা। ১৯৫২ সালে এ ভাষার জন্য বাঙালিরা প্রাণ দেয়। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালিরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। রফিক, সালাম, বরকতসহ আরো অনেকের রক্তের বিনিময়ে বাঙালিরা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। এমন ঘটনা পৃথিবীতে বিরল। বাঙালির আত্মপরিচয়ের ঠিকানা ও স্বতন্ত্র জাতিসত্তা তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই। ২১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। বিদেশী ভাষার আগ্রাসন ও প্রভাবে আমাদের মাতৃভাষা আগামীতে যাতে অস্তিত্ব সঙ্কটে না পড়ে তা নিয়ে একটি বাস্তবধর্মী উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক যোগাযোগে বাংলা ভাষার ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবনে মোবাইল ফোনে বাংলায় ক্ষুদেবার্তা (এসএমএস) চালুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ২১ ফেব্র“য়ারি ২০১২। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার বাংলা ব্যবহার সহজতর করতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আজ থেকে মোবাইল ফোনে বাংলায় এসএমএস পাঠানো ও পড়ার সুযোগ চালু করা হয়েছে। এছাড়া এ মাস থেকে সব ব্রান্ডের বেসিক মোবাইল হ্যান্ডসেটে পূর্ণাঙ্গ বাংলা কিপ্যাড সংযোজন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ডটবিডির পাশাপাশি দ্বিতীয় কান্ট্রি কোডেড টপ লেভেল ডোমেইন হিসেবে ডটবাংলা (. বাংলা) প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছি।’ সার্বজনীনতার জন্য বাংলা ভাষায় মোবাইলের কিপ্যাড করা হচ্ছে। প্রমিতকরণ ও রেজিস্ট্রেশন করে মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারীদের কাছে বিতরণ করা হয়েছে। বাংলায় যাতে সেবা নিতে ও দিতে পারে সেজন্য বাংলায় কিপ্যাড নেই এমন মোবাইল ফোনসেট আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ উদ্যোগের সাথে সঙ্গতি রেখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (এটুআই) প্রোগ্রাম তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য দেশের জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের অফিসের সেবা মানুষের কাছে সহজে দ্রুত পৌঁছে দেয়ার জন্য বাংলায় ২৫ হাজার ওয়েবপোর্টাল চালু করেছে। নি:সন্দেহে এসব উদ্যোগ প্রযুক্তিতে বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে মাইলফলক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় বাংলা ভাষায় তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ পাচ্ছে। প্রকান্তরে তা মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখায় সহযোগিতা করছে।

বিশ্ব বাস্তবতায় দেখা যায়, যেসব দেশ তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবনে ও প্রয়োগে এগিয়ে রয়েছে, সেসব দেশে প্রযুক্তিতে মাতৃভাষার ব্যবহার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এদিক থেকে বর্তমানে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগামী রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম চীন। চীনা ভাষার অক্ষরগুলো অত্যন্ত জটিল এবং প্যাঁচালো। কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। প্রযুক্তিতে মাতৃভাষা ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়ায় বর্তমানে চীনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫০ কোটিতে।

গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রের সীসারূপ ভাষা থেকে বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির ভাষারূপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে টিকে থাকবে সেই ভাষাগুলো, যা কিনা প্রযুক্তিবান্ধব। যেসব ভাষার লিখিত রূপ নেই, সেই ভাষাগুলোর অধিকাংশই পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। 

কোনো ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ভাষাবিদদের পাশাপাশি রাষ্ট্র এবং প্রযুক্তিবিদদেরও সক্রিয় হতে হবে। নিত্যনতুন প্রযুক্তিতে মায়ের ভাষাকে যুক্ত করতে হবে। মায়ের ভাষায় প্রযুক্তি ব্যবহার না করলে দেশ পিছিয়ে পড়বে। প্রযুক্তিও আটকে যাবে সীমিত গন্ডির মধ্যে। বিশ্বে ইংরেজি ভাষা জানা মানুষের সংখ্যা কম। শুধু এই কম সংখ্যক মানুষই ইংরেজি ভাষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তথ্যপ্রযুক্তির বেলায় এ ঘটনা ঘটছে মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ জাতীয় প্রযুক্তিপণ্যে। ইংরেজি ভাষার বাইরে অনেক দেশই প্রযুক্তিতে মাতৃভাষার ব্যবহার করছে। শুধু ভাষাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে নয়, মাতৃভাষায় যোগাযোগ দেশের মানুষের কাছে বোধগম্য হওয়ায় তা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। অনেকেরই ধারণা ইংরেজি না জানলে প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়না। তা ঠিক নয়। মোবাইল এবং ইন্টানেটের মাধ্যমে বাংলায় যোগাযোগে কোন সমস্যা নেই। তবে এ মূহুর্তে বাংলায় ভালো কনটেন্টের অভাব রয়েছে। দেশের ১১ কোটি ৬০ লাখ মোবাইল ফোন, সাড়ে চার কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারির কথা মাথায় রেখে মাতৃভাষায় ভালো ভালো কনটেন্ট ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হলে তা শুধু মানুষকে জ্ঞানার্জন, তথ্য ও সেবা পাওয়া নিশ্চিত করবে না, মাতৃভাষাকে বাঙালির মাঝে চিরঞ্জীব করতে সহায়তা করবে।

 

 

 

ছবি
ডাউনলোড